তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য চর্চাঃ একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা থেকে জন্ম

– কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা

ভূমিকা:


পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সাহিত্যটা গড়ে উঠে একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা থেকে বিশেষ করে তঞ্চঙ্গ্যাজাতির সাহিত্যটা। জুম চাষের মধ্য দিয়ে তারা তাদের সাহিত্যের স্বপ্নগুলিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেত এবং জীবনের বীজ বুনতো। তঞ্চঙ্গ্যারা এই জুমকে ভালোবাসে এবং এই জুম সংস্কৃতিকে ধারণ করে তারা সেই স্বরণাতীতকাল থেকে এই অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। স্বরণযোগ্য যে বর্তমানে যারা তন্চংগ্যা বা তঞ্চঙ্গ্যা নামে পরিচিত, এককালে তারা দাইনাক বা দৈনাক পরিচয়ে আরাকান বা মায়ানমারের প্রাচীন স্বাধীন রাজ্য দান্যাওয়াদি থেকে এই অঞ্চলে এসেছিল। পরবর্তীতে তারা তঞ্চঙ্গ্যা নামে কক্রবাজার ,টেকনাফ ও বান্দরবানের সীমান্তবর্তী তৈনছড়ি-তৈনগাঙ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম বিলাইছড়ি, কাপ্তাই, রাঙ্গামাটির অন্যান্য অঞ্চল ও চট্টগ্রাম জেলার রইস্যাবিলি রাঙ্গুনীয়া অঞ্চলে। তবে কক্রবাজার এবং টেকনাফের তঞ্চঙ্গ্যারা এখনো অনেকে চাকমা পদবী ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু কথা বলেন তঞ্চঙ্গ্যার ‘মো’ গছাদের মতো। আবার অনেকে বর্তমান তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে আসল চাকমা বলেও মানেন, এটি অবশ্যই ইতিহাসের পাঠ্য। পরে অনেকে কাপ্তাই বাঁধের নতুন ইতিহাসের নিরব সাক্ষী ও স্বীকার পরবর্তী বাসিন্দা ভারতের নানা প্রদেশ। সাধক কবি শিবচরণ, রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, রাজ গেঙ্গুলী জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থির এর মতো প্রগতিযশা ব্যক্তি জন্ম গ্রহন করে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি আজ একটি আলোকিত জাতি হিসেবে স্বকৃীত।

আমি যখন কলেজে পড়তাম তখন থেকে একটি চিন্তা আমার মাথায় সবসময় ঘুরপাক খেত, তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্য ও সংস্কৃতি তথা আদিবাসীদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে নিয়ে। আমি যতটুকু জানি তঞ্চঙ্গ্যারা সাহিত্য ও সংস্কৃতির দিক থেকে ঐতিহাসিক ভাবে সমৃদ্ধশালী। নানা কারণে এই ঐতিহাসিক সম্পত্তিগুলি তঞ্চঙ্গ্যাারা রক্ষা বা লালন-পালন করতে পারেনি এটি তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ব্যর্থটা নয় এটি ঐতিহাসিকতার ব্যর্থটার ফল।

তন্চংগ্যাদের সমৃদ্ধ সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপাদান ছিল শুধু এই কথা বলে বসে থাকলে আমাদের চলবে না,চর্চা এবং লালন-পালন করে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। মুলতঃ এই আগ্রহ এবং দায়িত্ববোধ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তন্চংগ্যা ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে প্রকাশনা বের করার চিন্তাটা প্রথমে আমার মাথায় আসে যখন আমি ২০০১-০২ সেশনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্র্তি হই। তাছাড়া আমি যতদূর জানি তঞ্চঙ্গ্যাদের নিয়মিত কোন প্রকাশনা বের হয় না। পরে মিটিং এর মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় প্রকাশনা বের করার। অনেক নাম প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে অজয় দা’র (অজয় বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা) দেওয়া নাম ‘পহ্র জাঙাল’ সর্ব সম্মতিত্র“মে গৃহিত হয়। এরপর ১লা বৈশাখ ১৪১০ বাংলা, ১৪ই এপ্রিল ২০০৩ ইংরেজী পহ্র জাঙাল প্রথম সংখ্যা সফলভাবে প্রকাশিত হয় এবং উদ্বোধনী সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন পলাশ তন্চংগ্যা। ১১ই এপ্রিল’০৩ ওয়া¹া উচ্চ বিদ্যালয়ে চাকমা সার্কেল চীফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় এটির প্রথম সংখ্যা মোড়ক উম্মোচন করেন। এর আগে অবশ্যই বলাকা,বিষু,ছিনা-মোইন(২০০২)এক সংখ্যা করে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে পহ্র জাঙাল এর হাত ধরে তৈনগাঙ, রাঙাফুল, ন-আ শমন প্রকাশ হয়। তৈনগাঙ এখনো নিয়মিত প্রকাশ হলেও বাকীগুলো কিছু সংখ্যার পর আর প্রকাশ হয়নি। তবে প্রতিটি সংখ্যায় এক ঝাক প্রতিভাবান তরুণ-তরুণী আগমনীর বার্তা আমাদের আন্দোলিত এবং অনুপ্রাণীত করেছিল।

তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়-


(ক) প্রথম ভাগে- সাধক শিবচরণ এবং ঐতিহাসিক সাহিত্যকর্ম সৃষ্টিকারী (খ) দ্বিতীয় ভাগে- রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, গোবীনাথ তঞ্চঙ্গ্যা,কবিরত্ন শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির,ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির,যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যাা, রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা।
(গ) তৃতীয় ভাগে- লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা,এ্যাড.দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা, সুদত্ত বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা, ভোলানাথ তঞ্চঙ্গ্যা (বি.এন),পারমিতা তঞ্চঙ্গ্যা, উচ্চতমনি তঞ্চঙ্গ্যা, তাপস তঞ্চঙ্গ্যা, অজয় বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা, ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা,কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা,উজ্জ্বল কুমার তঞ্চঙ্গ্যা (মনিচান),দীপঙ্কর তঞ্চঙ্গ্যা, আরিয়াজ্যোতি ভিক্ষু, মিলিন্দ তঞ্চঙ্গ্যা। আরো অনেকে।

ক. প্রথম ভাগের লেখকদের মধ্যে আমি তন্চংগ্যা সাহিত্যের পটভূমিকার সমৃদ্ধ বীজ লক্ষ্য করি পরবর্তীতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগেও এই লক্ষণটি স¤প্রসারিত হয়। যদিও প্রথম ভাগটি শুরু হয় মধ্যযুগীও সাহিত্যের সাথে মিল রেখে ধর্মীয় অনুভূতিতে। এটি মূলতঃ লেখকের সাথে সময়ের একটি যোগসূত্র, আমরা এটাকে সময় বা সমাজের চাহিদাও বলতে পারি। পরবর্তীতে দ্বিতীয় ভাগের রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা,গোবীনাথ তঞ্চঙ্গ্যা,কবিরতœ শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা,রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির, ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির, শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা এবং শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যাদের লেখার মধ্যেও এই লক্ষণটি স্পষ্ট। তবে এখানে ইতিহাসও যোগ হয়েছে। মূলত একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা থেকে তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যের জন্ম। যা জাতি হিসেবে যে কেউ গর্ববোধ করতে পারে। তারা সমাজ এবং ইতিহাসকে সাথে নিয়ে বাংলা, তঞ্চঙ্গ্যাও চাকমা ভাষায় এইসব রচনা করেন।

খ. দ্বিতীয় ভাগের প্রত্যেকটি লেখক সমাজ সচেতন ও প্রগতিযশা ছিলেন। সমাজ ও জাতির জন্য তাদের অবদান অনেক। রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যার নিজস্ব হস্তচালিত প্রেস ছিল। সম্ভবতঃ পার্বত্য চট্টগ্রামে এটিই প্রথম প্রেস। এখানে উলে­খ্য যে, বিংশ শতকের দিকে এসে ‘গৈরিকা’(১৯৩৬) পার্বত্য চট্টগ্রামে সাহিত্যের একটা ধারা সৃষ্টি করলেও তার আগে কিন্তু তঞ্চঙ্গ্যাদের কর্তৃক ‘ধর্ম্মধ্বজ জাতক’(১৯৩১),‘সত্য নারায়ণের পাঁচালী’(১৯৩৩) রচিত হয়। তার এই ‘ধর্ম্মধ্বজ জাতক’পয়ার ছন্দে রচিত একটি মূল্যবান ধর্মীয় গ্রন্থ। এই প্রেক্ষিতে তন্চংগ্যা সাহিত্যিকগণই গৈরিকার পথ প্রর্দশক ছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা ধর্ম- সাহিত্যের দিক থেকে চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের আদি কবি (ড.মনিরুজ্জামান, পহর জাঙাল-৪র্থ সংখ্যা-২০০৮, পৃষ্ঠা-১০)। এই পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যাাকে রাজা ভুবন মোহন রায় ‘রাজকবি’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আর কবিরতœ শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তন্চংগ্যা একজন স্বভাব কবি ছিলেন। তিনি মুখে মুখে ছন্দ বাক্য রচনা করতে পারতেন(তথ্যঃ এ্যাড.দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা)। ‘ধর্ম্মধ্বজ জাতক’ সম্পাদনা ও সংশোধিত আকারে প্রকাশের জন্য রাজস্থলী বিহারপতি কর্তৃক ‘পন্ডিত’ এবং রাঙ্গুনিয়া উত্তর পদুয়া বৌদ্ধ সমিতির এক অনুষ্ঠানে প্রিয়দর্শী ভিক্ষু কর্তৃক ‘উদয়ন বস্তু’ রচনার জন্য তাকে ‘কবিরতœ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট্য ভাষা বিজ্ঞানী ড.মনিরুজ্জামান তাকে ‘পাহাড়ী বাংলার কবি’ বলেছেন। তার কিছু অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি লেখক (কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা) তাঁর পুত্র দিলিপ কান্তি তঞ্চঙ্গ্যার মাধ্যমে উদ্ধার করেন ১২ই জুন ২০০৮ সনে রাজস্থলী থেকে। তার এই অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি লেখক দায়িত্ব নিয়ে ‘পহ্ র জাঙাল প্রকাশনা পর্ষদ’ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করার ব্যবস্থা গ্রহন করেন। ইতিমধ্যে রাধামন ধনপতি কাব্য, বিজয়গিরি, মানুষ দেবতা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। অন্য সবার ক্ষেত্রেও পহ্র জাঙাল একই আগ্রহ পোষণ করে। আর পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ ধর্ম সুবিস্তারে যার অবদান সবচেয়ে বেশী তিনি হচ্ছেন রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির। ২৬ শে ডিসেম্বর ১৯৫৭ সালে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলে রাজা ত্রিদিব রায় তাকে পূর্ণ মর্যাদায় ‘রাজগুরু’ পদে বরণ করেন। এর আগে রাজা নলিনাক্ষ রায় কর্তৃক শ্রীমৎ প্রিয়রত্ন মহাস্থবিরকেও (গৃহী নাম পালকধন তঞ্চঙ্গ্যা) ‘রাজগুরু’ মর্যাদায় ভূষিত করা হয়। তিনি ১৯৫৪-৫৬ সাল পর্যন্ত রেঙ্গুনে অনুষ্ঠিত‘ষষ্ঠ বিশ্ব বৌদ্ধ মহাসংগীতি’তে একজন সংগীতিকারক হিসেবে উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন। তারই অমূল্য অবদানের জন্য মহাসংগীতি আয়োজক কমিটি তাকে ‘অগ্গ মহাপন্ডিত’ উপাধিতে সম্মানিত করেন। এছাড়া ২০০৪ সালে মায়ানমার সরকার কর্তৃক তাকে ‘অগ্গ মহাসধোম্মজ্যোতিকাধ্বজ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির এর মাধ্যমে সম্ভবতঃ পার্বত্য আদিবাসীদের মধ্যে তন্চংগ্যারাই সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। তার সুবিচক্ষণতার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ‘রাউলী’ স¤প্রদায় বিলুপ্ত হয়। সেসময় রাউলী স¤প্রদায় চাকমা ও বড়–য়াদের ধর্মীয় পুরোহিত হিসেবে ছিলেন। এই অগ্রবংশ মহাস্থবির ও ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবিরের অপ্রকাশিত অনেক লেখা রয়ে গেছে। এই লেখাগুলি ছাপানোর ক্ষেত্রে সমাজের সচেতন এবং বিত্তবানদের সুদৃষ্টি কামনা করছি। কারণ এগুলি আমাদের জাতীয় মূল্যবান সম্পদ। আমি যতটুকু শুনেছি এরই মধ্যে রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবিরের কিছু মূল্যবান পান্ডুলিপি খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। সুযোগে কেউ হয়তো নিজের নামে চালিয়ে বা ছাপিয়ে নিতে চেষ্টা করবে। যেটা হলে আমরা ঠিক আগের মতো ঐতিহাসিক ভাবে আবার ভুল করবো বা ভুল করতে যাচ্ছি।

গ. তৃতীয় ভাগের লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান হচ্ছেন লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা।।তার লেখার মধ্যে ইতিহাস ও সমাজ সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। নবীন লেখকদের অনুপ্রেরণাদায়কও তিনি। আমার জানা মতে ১৫-২০টি পসন এবং ৩৫০-৪০০টি প্রবাদ তার সংগ্রহে রয়েছে যা আমাদের মূল্যবান সম্পদ। ড.মনিরুজ্জামান স্যারকে তার ‘প্রবাদ ও তঞ্চঙ্গ্যা প্রবাদের সাংস্কৃতিক অভিমুখ’(৫ম সংখ্যা, ৯ই আগস্ট-২০০৯, সম্পাদকঃ কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা) লেখার জন্য এই প্রবাদ সংগ্রহশালা থেকে লেখক রেফাসেন্স হিসেবে সংগ্রহ করে দেন। ভোলানাথ তঞ্চঙ্গ্যার ইতিহাসের পুরনো দিনের স্মৃতিকে ধারণ করে রচিত ‘আদামর ফুল’ তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্য ভান্ডারে অমূল্য সম্পদ যা পহ্র জাঙাল প্রকাশনায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে। আর এ্যাড.দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যার ‘তঞ্চঙ্গ্যা জাতি’ নামে একটি লেখা ‘বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি’র ৫ম ভলিউমে প্রকাশিত হয়। তাছাড়া ‘বাংলা পিডিয়া’তেও প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। নারী লেখিকাদের মধ্যে পারমিতা তঞ্চঙ্গ্যা অগ্রগামী, পুরো পার্বত্য অঞ্চলেও তিনি যথেষ্ট সুপরিচিত। তার লেখা সাহিত্যগুলি জুম্ম জাতি ও নারী সমাজকে আলোড়িত করে। পারমিতা তঞ্চঙ্গ্যা নারী লেখকের প্রতিনিধি। কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা ‘পহর জাঙাল’ প্রকাশনার স্বপ্নদ্রষ্টা এবং উদ্যেগটা। তার কবিতা এবং প্রবন্ধ চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন স্থানীয় পত্রিকা ও লিটলম্যাগে প্রকাশিত হয়েছে। তার মোট প্রকাশিত প্রবন্ধ সংখ্যা প্রায় ১৫-২০টি। তার লেখা প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিটিউট থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা (বাতকস) এর মুখপত্র সিঙকাবা এর প্রধান সম্পাদক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত আদিবাসীদের সাহিত্য পত্রিকা ‘রদেঁভু’ এর তিনটি সংখ্যা সম্পাদনা করেন। সাস এনজিও থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা ‘খৈয়ুম’ এর নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ ছাত্র-ছাত্রী কর্তৃক প্রকাশিত ‘ধূপছায়া’ এর সহ-সম্পাদক ছিলেন। তিনি সম্ভবত তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে সর্বপ্রথম পান্ডুলিপি সংগ্রাহক।

পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসীদের মতো তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য চর্চাটি এগিয়েছে কিছু ঐতিহাসিক সংস্কৃতির উপাদান এবং সময়ের পটভূমিকে কেন্দ্র করে।

১. জুম সাহিত্যঃ


পাবর্ত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসীদের মতো তঞ্চঙ্গ্যারাও জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। তারা জুম চাষের জন্য প্রতি বছর উর্বর জায়গার সন্ধানে পাহাড়ের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরীত হয়। যার ফলে তাদের জীবনচক্রও গড়ে উঠেছে এই জুমকে কেন্দ্র করে। ফলে দেখা যাচ্ছে তাদের জীবন ধারণ এবং সাহিত্যের উপকরণ হিসেবে জুম উঠে এসেছে খুব সহজে। যেটি আমরা লক্ষ্য করেছি তন্চংগ্যাদের আদি সাহিত্যের মধ্যেও। বারোমাস,উভাগীত,পসন্,ধাঁধা,কবিতা,ছড়ার মধ্যে আমরা এই জুমকে খুজে পাই। এই জুমকে কেন্দ্র করে কয়েকটি পালাও রচিত হয় তার মধ্যে ‘জুম কাবা, রাইন্যা বেড়ানা পালা’ অন্যতম। ইতিহাস বলে তৎসময়ে প্রেমিক-প্রেমিকাদেরও চিত্ত বিলাসের অন্যতম স্থানও এই জুম। যেটি গিংগুলী গানের গায়কের কন্ঠে আমরা লক্ষ্য করি। বিষ’ুর সময় যে পাইসন রান্না হয় তার বেশী ভাগ সবজি কিন্তু পাওয়া যায় এই জুম থেকে। তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েদের পাঁচ কাপড়(পিনউন, খাদি, মাদা কাবং, পা-দুরি, সালুম) বুননে যে ফুল গুলি ব্যবহার করা হয় তার বেশীর ভাগ নাম এই জুম সবজি থেকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে মাতৃভাষায়(এম.এল.ই) যে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে ওখানেও জুম বিষয়ে গল্প, ছড়ার বই ও থিম পিকচার করা হয়েছে। বর্তমানের লেখকদের মধ্যেও এই জুম সংস্কৃতি ঘুরে ফিরে চলে আসছে।

২. সাধক শিবচরণ এবং গসাইন্ লামাঃ


আমরা কম-বেশী সবাই শিবচরকে কবি হিসেবে চিনলেও কিন্তু কবি’র চেয়ে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি সাধক বা ব্যাদি হিসেবে বড় ছিলেন। ব্যাদির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-এই আছে এই নেই,তারা মুহুত্বের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। তারা চারিযুগ অমর এবং যমসুরী। এই চারিযুগ হচ্ছে-সত্যযুগ,দ্বাপরযুগ,টেট্টাযুগ ও কলিযুগ। শিবচরণ শৈশব কাল থেকেই ভাবুক প্রকৃতির ছিলেন। জগৎ সংসার থেকে মুক্তিই যেন তার একমাত্র নেশা। তার আধ্যাত্বিকটা মা,ভাই ও ভাবীকে ভাবনা এবং চিন্তার দোলাচলে ফেলে দিলেও মাঝে মধ্যে বৎসনা করতেন জগৎ সংসারের প্রতি তার উদাসীনতা দেখে।

শিবচরণ ‘মানবজন্ম’ এবং ‘ফুইরা আলাম’ নামে দুটি গ্রন্থ লিখেন। ‘মানবজন্ম’ গ্রন্থের বিষয়বস্তু হচ্ছে মানুষের শরীরগত বিদ্যাকে নিয়ে। শরীর কি,শরীর কি দিয়ে তৈরী বা গঠিত হয়েছে,শরীরের কোথায় কি আছে,কার কি কাজ ইত্যাদি বিষয়কে এখানে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আর ‘ফুইরা আলাম’ গ্রন্থে তন্চংগ্যাদের ৩৬(ছত্রিশ)টি অক্ষরের(বর্ণমালা)বর্ণনা আছে। যেগুলোকে ‘আন্জী অক্ষর’ বলা হয়। আনজী অক্ষর হলো-একটি অক্ষরের ‘গভীরতম অর্থ’ যেখানে সৃষ্টির পেছনে কারণ বা রহস্য নিহিত থাকে। যেমন-‘অ’তে বুদ্ধ অনিত্য বুঝেছেন। এই অক্ষরগুলো মাধ্যমে পুরো শরীরের অবস্থান,অংশ বা গঠনকে বুঝা যায়। শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কার কোথায় অবস্থান এই আনজী অক্ষর দিয়ে নির্ধারণ এবং চিহ্নিত করা যায়। বৈদ্য বা কবিরাজ-রা এই আনজী অক্ষরের মাধ্যমে ‘নাড়ীবেদ’ পরীক্ষা করে রোগী চিকিস্যা করে। এই বিষয়ে প্রত্যেকটি বর্ণনা আছে এই গ্রন্থে। ‘মানবজন্ম ও ফুইরা আলাম’ দুটো গ্রন্থের ভূমিকা হচ্ছে মূলতঃ গসাইন বা গোসাইন লামা। শিবচরণ সাধক বা ব্যাদি ছিলেন। (তথ্যঃ বৈদ্য ফুলেশ্বর তঞ্চঙ্গ্যা,গর্জনীয়া পাড়া-ওয়াগ্গা ,বয়স:৬৫,তারিখঃ১১/০৯/২০১০,রোজ শনিবার)। তিনি তার গসাইন্ বা গোসাইন্ লামায় উলে­খ করেছেন যে,“সাকিন্ ছালাম য্যং মুই কাপ্তেই গাং,মানিয়া পুরীত্তুন্ তুরি যাং” অর্থাৎ সাকিন কাপ্তাই গাঙকে ছালাম জানিয়ে,আমি মনুষ্য ধরাধম থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছি। আমি একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি যে,চাকমারা গৌতম বুদ্ধ বা বুদ্ধ মুর্তিকে গোজেন বলে না। তারা বলে গোই(ঐ)। কিন্তু তঞ্চঙ্গ্যারা গৌতম বুদ্ধ বা বুদ্ধ মুর্তিকে গসাইন বা গোসাইন বলে। তাছাড়া আমি আরো লক্ষ্য করেছি যে শ্রী অশোক কুমার দেওয়ান কর্তৃক সংগৃহীত ‘চাকমা ভাষায় শব্দ কোষে’গ্রন্থে(সুগত চাকমা কর্তৃক সম্পাদিত ১৯৯৬ সনে প্রকাশিত) গোজেন শব্দটি অনুপস্থিত। গসাইন বা গোসাইন লামা গ্রন্থ থেকে জানা যায় শিবচরণের জন্ম ১১৮৪ মঘী বা মঘাব্দ আর ইংরেজী সন হচ্ছে ১৮২২ সাল। (রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা জাতি,প্রকাশ-২০০০ এপ্রিল)

এই সাধক বা ব্যাদি শিবচরণের জন্ম কাপ্তাই এর নাড়াই পাহাড়ে। আবার অনেকের মতে বর্তমান রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার অর্ন্তগত রাজস্থলী বাজারের নিকটবর্তী বাজার নাড়ামূখ পাড়া গ্রামে। লক্ষনীয় বিষয় দুটি নামের মধ্যে কিন্তু একটা শব্দগত মিল আছে। এখানে আরো উলে­খ্য যে এই পাড়ার পাশ দিয়ে যে নদীটা বয়ে গেছে তার নাম কাইত্তি গাঙ বা কাপ্তাই নদী। তাছাড়া আগে কাপ্তাই,বিলাইছড়ি,রাজস্থলীটি চন্দ্রঘোনার থানার অর্ন্তভুক্ত ছিল। এই পাড়ার গ্রামবাসীরা এক সময় মাতামহুরীর তৈনগাঙে বসতি স্থাপন করেন। আমরা যদি ইতিহাসকে সামনে নিয়ে আসি তাহলে দেখব তন্চংগ্যারা আরাকান থেকে এসে প্রথমে তৈনছড়িতে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তারা ছোট ছোট অংশে উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলের দিকে ছড়িয়ে পড়ে(রাইংখং,কাপ্তাই ওয়া¹া অঞ্চল)। আর তারা আরাকান থেকে আসার সময় কাল­াঙের (ঝুড়ি) করে বুদ্ধ মূর্তি নিয়ে আসে।(রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা জাতি,প্রকাশ-২০০০ এপ্রিল)। পরবর্তীতে যুদ্ধের কারণে তারা তাদের এত দিনের বাসস্থান(কাপ্তাই)ছেড়ে আবার তাদের আদি বাসস্থান মাতামুহুরি নদীর উপনদী তৈনছড়িতে চলে যায়। ঐতিহাসিকভাবে আমরা সবাই অবগত যে তৈনছড়ি বা তৈনগাঙ এর সাথে তন্চংগ্যাদের ইতিহাস অতোপ্রতোভাবে জড়িত আর এখানেই কিন্তু শিবচরণের শৈশব ও কৈশোরকাল কেটেছে। এই ঐতিহাসিক যুক্তি বা তথ্য থেকেই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় কিনা-কবি শিবচরণ তন্চংগ্যা জাতির গর্বিত সন্তান ছিলেন। তার রচিত গসাইন/গোসাইন লামা তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ঐতিহাসিক সম্পত্তি। এর সাথে গেঙ্গুলী বা উবাগীতের পালা,বারোমাস,গল্প,প্রবাদ-প্রবচনের মতো ঐতিহাসিক সম্পত্তিগুলিও দাবীর তালিকায় থেকে যাচ্ছে। কারণ শিবচরণের গসাইন লামার সাথে এইসব সৃষ্টির একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে। যদি উলে­খিত বিষয় বা মতগুলি ঐতিহাসিকভাবে সত্যি হয় তাহলে আমি বলবো পার্বত্য জাতি গোষ্ঠীর ইতিহাস বিশেষ করে চাকমা জাতির ইতিহাস নিয়ে আরও নতুন করে ভাববার অবকাশ থেকে যাচ্ছে বা সময় এসেছে।

৩. তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা, বর্ণমালা ও ভাষার বইঃ

তন্চংগ্যাদের ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বর কোমল ও নরম। উচ্চস্বরে এবং গলা তুলে কথা বলা তাদের বৈশিষ্ট্যে নেই। তাদের স্বরের মধ্যে সবসময় নরম ও কোমল টান লক্ষণীয়। বর্তমানে এসে ভাষার আদিরূপটা প্রাকৃতিক নিয়মে পরিবর্তন লক্ষনীয় হলেও বর্তমান প্রজন্ম এই নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। তারা নিজ ভাষা ব্যবহার ও চর্চাকে অধিকারবোধ থেকে চিন্তা এবং বিচার করে। তারা সবসময় সচেতনভাবে সচেষ্ট থাকে চর্চার অভাবে নিজ ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে কিনা বা অন্যের ভাষার প্রভাবে নিজ ভাষা কোন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিনা। তবে অনেকের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও লক্ষনীয়। জানিনা তারা নিজেদেরকে অভার র্স্মাট বা অতি বিশ্বায়নী হিসেবে ভাবেন কিনা। আমি ভাষা জানাকে প্রয়োজনীয় হিসেবে মেনে নিয়ে নিজের সমৃদ্ধ ভাষাকে ছেড়ে অন্যের ভাষাকে নিজ মাতৃভাষার মতো ধারণ এবং চর্চাকে প্রয়োজনের মধ্যে পড়ে কিনা জানি না। ভাষার মধ্যে দিয়ে কিন্তু জাতির পরিচয় ফুটে উঠে বা বহন করে। ভাষার মাধ্যমেই জানা যায় কে কোন জাতির বা জনগোষ্ঠীর লোক। এই মাঝে ভাষা নিয়ে নিজের একটা চোট্ট অভিজ্ঞতা শেয়ার করি- একদিন অফিস থেকে বের হয়ে গরু দুধ কিনব বলে দোকানে গিয়ে দোকানিকে (দোকানি ৪০/৪৫ বছর বয়সের একজন চাকমা ভদ্র মহিলা) বললাম তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায়- ‘ম-ই গোরু দোউত্ আহে’ ( মাসি গরু দুধ আছে)। আমার কথা শুনে দোকানি বলল- আছে। আমার কথা শুনে চাকমা ভদ্র মহিলা জিজ্ঞেস করলেন- তুই কি তঞ্চঙ্গ্য নে ? আমি বললাম হ্যাঁ। পরবর্তীতে আমি চিন্তা করলাম শুধুমাত্র ভাষার জন্য হয়তো উনি আমাকে ‘বাবু আপনি তঞ্চঙ্গ্যা’ বলে সম্বোধন করেছেন বা চিনতে পেরেছেন। না হলে হয়তো উনিও দশজনের মতো চেহারাগত সাদৃশ্যের কারণে আমাকেও একজন চাকমা বলে জানতেন। সুতরাং শুধুমাত্র ভাষার কারণে উনি আমাকে তন্চংগ্যা হিসেবে চিনতে পেরেছেন, অন্যথায় নয়। হয়তো এই উপলদ্ধি থেকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন আগে নিজ ভাষা গাথুনী পরে অন্য ভাষা। কারণ আমি বুঝি আমি যদি আমার ভাষা চর্চা বা ব্যবহার না করি অন্য কেউ এসে তা করে দিবে না। আর সেটি চর্চার অভাবে কোন একদিন হারিয়ে যাবে। আর আমরা সবাই অবগত প্রতিদিন পৃথিবী থেকে দুই/একটি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। তন্চংগ্যাদের ভাষাও যে হারিয়ে যাবে না এতে কোন সন্দেহ নেই।

তঞ্চঙ্গ্যাদর ভাষা ও বর্ণমালা আজ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কারণ বাংলাদেশ সরকার, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ইউএনডিপি’র প্রত্যেক্ষ সহযোগিতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রামে আর ১২টি জাতির মতো তঞ্চঙ্গ্যাদের জন্যেও নিজস্ব বর্ণে এবং স্বভাষী শিক্ষক দিয়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এখন যদি কেউ বলে তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা এবং বর্ণমালা নেই তাহলে তিনি আইনগত অপরাধী হিসেবে গন্য হবেন। এর আগে অবশ্যই বর্ণমালা ব্যবহার ক্ষেত্রে তঞ্চঙ্গ্যা বৈদ্যরা অগ্রগামী। তবে শুনে এসেছি তন্চংগ্যা বৈদ্যরা যে বর্ণমালা ব্যবহার করতেন সেগুলো নাকি চাকমা বর্ণমালা। পরে ইতিহাস পাঠে জেনেছি তঞ্চঙ্গ্যারা যদি আসল চাকমা হন তাহলেতো এই বর্ণমালাগুলি চাকমা বর্ণমালা পক্ষান্তরে তঞ্চঙ্গ্যা বর্ণমালা হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া আমি একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি যে, তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালার সাথে বর্তমান উভয়(তঞ্চঙ্গ্যাও চাকমা) বর্ণমালার একটা সাদৃশ্যের ঐক্যমান লক্ষণীয়। যেটি চাকমাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। যেমন- তঞ্চঙ্গ্যারা অধিক মাত্রায় বর্ণমালা উচ্চারণ করে আ-কারান্ত দিয়ে (কিছিম্যা কা, গছিম্যা খা, চাইন্দ্যা গা- খাই, যাই, গাই ইত্যাদি) এবং কথা বলেও আ-কারান্ত দিয়ে। আর চাকমারা তাদের বর্ণমালা উচ্চারণ করে আ-কারান্ত দিয়ে কিন্তু কথা বলে অধিক মাত্রায় এ-কারান্ত দিয়ে(চুচাঙ্যা কা, গুজাঙ্যা খা, চান্দ্যা গা-খেই, যেই, গেই ইত্যাদি)। একদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট ভাষা বিজ্ঞানী ড.মনিরুজ্জামান স্যারের সাথে এই বিষয়টি আলাপ করলে তিনিও গবেষণার যোগ্য এবং লক্ষণীয় বিষয় বলে মত দেন।

অনেক আগে থেকে তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালা থাকলেও সেটি কিন্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিচ্ছিন্ন এবং বিক্ষিপ্তভাবে ছিল। পরে ভারতীয় এক গবেষক রূপক দেবনাথ বার্মা, ভারত ও বাংলােেদশ ঘুরে একটা সাজানো এবং গোছানো রূপ দাঁড় করান। একে সর্বাত্বকভাবে সহযোগিতা প্রদান করেন এ্যাডভোকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা এবং বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যাকল্যাণ সংস্থা(বাতকস)। মূলতঃ তঞ্চঙ্গ্যারা ‘তঞ্চঙ্গ্যা বর্ণমালার একটি গোছানো রূপ’ পাওয়ার ক্ষেত্রে রূপক দেবনাথ ও এ্যাডভোকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যার অবদান স্বরণীয়। আর সফ্ওয়ার উন্নয়নে জন্ ক্লিফটন্।

পার্বত্য চট্টগ্রামে তঞ্চঙ্গ্যাদের জন্য স্ববর্ণে এবং স্বভাষী শিক্ষক দিয়ে যে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে সেখানে গল্প বই(বিগ বুক),ছড়া বই(শুনার গল্প),বর্ণমালার বই,বর্ণমালা চার্ট,নাম্বার চার্ট,কার্ড এবং অংক বই প্রকাশিত হয়। সাথে আরো ছবি সম্বলিত সিরিজ পিকচার এবং থিম পিকচার প্রকাশিত হয়। এগুলি যৌথভাবে সম্পাদনা করেন বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা কমিটি, মৃণাল কান্তি তঞ্চঙ্গ্যাও কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা(মাল্টিলিংগুয়াল শিক্ষা অফিসার যখন ছিলেন)। এই শিক্ষা কার্যক্রমে গল্প ও ছড়া লেখার ক্ষেত্রে যাদের অবদান অনস্বীকার্য তারা হলেন-সত্য বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা,লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, মিলন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা,বিজয় তঞ্চঙ্গ্যা (কুতুবদিয়া)। আর বর্তমানে ক্লাস ওয়ানের উপযোগী ‘আমার বই আর গণিত বই’ তৈরী করার কাজ চলছে। আর এইসব বই বা উপকরণ তৈরীর জন্য ১৫(পনের) সদস্য বিশিষ্ট একটি তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা কমিটিও আছে।

৪. লোকসাহিত্যঃ

তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যের অন্যতম অহংময় উপাদান হচ্ছে তাদের প্রাচুর্য্যময় লোকসাহিত্যের ভান্ডার। সে সময়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক আচার-আচরণের সাথে নিত্যদিনের কর্মকান্ডে এবং চিন্তা ভাবনা এই সাহিত্য ফুটে উঠছে। তার মধ্যে উবাগীত, প্রবাদ, ধাঁধা, গল্প, ছড়া ও বারোমাস উলে­খযোগ্য।

উবাগীতঃ

আদিকাল থেকে তঞ্চঙ্গ্যাদের একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম ছিল গেঙ্গলী/উবাগীতের অনুষ্ঠান। নবান্ন উৎসবে এই গানের আসর বসত। তাছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ধর্মীয় কীত্তনের পাশাপাশি এই গেঙ্গলী গান হতো। বিয়ের অনুষ্ঠানেও এই গানের আয়োজন হতো। যারা এই গানের রচয়িতা তাদের প্রাকৃতিক জ্ঞান অকল্পনীয়। তারা তাদের চিন্তাকে সুপ্রসারিত করেছে সে সময়ের জ্ঞানকে আশ্রয় করে। বিশেষ করে তারা রোমান্স ও ইতিহাসকে সাথে নিয়ে এই অমর সাহিত্য ভান্ডার সৃষ্টি করেছে। এই গানে একটা সুর থাকত যেটা আমরা পাহাড়ী বা আদিবাসী সুর বলি। এই সুরের সাথে প্রাকৃতি,ঝর্ণা,পাখির কূজন,বনভূমি একাকার হয়ে যেত। যেন স্বয়ং প্রকৃতি সুর দিচ্ছে, সুর তুলছে এবং সুর মিলাচ্ছে। এই গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একটি কাহিনী থাকে এবং পঙ্তির শেষে অন্ত মিল থাকবে। আর এটি গাইতে হয় বেহেলা দিয়ে। এই গেঙ্গুলীদের মধ্যে জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা অন্যতম। যাকে সবাই কানাগেঙ্গুলী হিসেবে চিনে। স্বরস্বতীর অকৃপন কৃপায় তিনি অসাধারণ অনুভূতি শক্তি ,স্মৃতি ও মর্মাবধারণ সম্পন্ন সেকাল একাল শ্রেষ্ঠ গেঙ্গুলী হিসেবে তিনি সমাদৃত। তিনি ভূবন মোহন,নলিনাক্ষ ও ত্রিদিব রায় এই তিন রাজার অতি প্রিয়ভাজন ছিলেন। রাজা নলিনাক্ষ রায় তাকে ‘রাজগেঙ্গুলী’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। সেই অগনিত নাম না জানা ত্যাগী, গুণী ও জ্ঞানীদেরকে অসীম নমঃ নমঃ এবং জয়তু। এই রকম কিছু পালা বা রচিত সাহিত্য তন্চংগ্যা সমাজে খুবই পরিচিত।

উবাগীতের পালাসমূহঃ

জুম কাবা পালা,রাইন্যা বেড়ানা পালা,নাকসু ফুল পারা পালা,ঘিলা পারা পালা,রদংস পালা,বার্কী ধরা পালা,চাদিগাঙ ছড়া পালা,রাধামন ধনপতি পালা,লক্ষী পালা,ধর্ম পালা,রিজার্ভ পালা,অলঙ্গা-অলঙ্গী পালা(রাইন্যা বেড়ানা পালার একটা শাখা),লাঙ্যা-লাঙ্যনী পালা,মেদঙা-মেদঙী পালা,মিয়াধন-মিয়াবী,কুঞ্জধন-কুঞ্জবী,নিলংধন-নিলংবী,কামিতধন-কামিতবী,হিরাধন-হিরাবী,মানিকধন-মানিকবী এবং মেজংবী-মেজংধন তাদের মধ্যে অন্যতম।(পালাগুলি লেখক কর্তৃক সংগৃহীত) নিম্মে একটি উবাগীতের পঙ্তি দেওয়া হলো-

নানান-ভই-চর নানান রং,
ধানে সুধায় উ-ল সং।
ধান ছরাত ধুল­ রঙ,
গাবুজ্যা গাবুরী উলাক সং।
দেবংশী ফুলর গিলার তাক্,
আদামত্ বেড়াইদন গাবুরী ঝাক।
উদানত্ খেলিদন্ গুরালক্,
পাল,পাল বেড়াইদন্ গাবুরলক।
উরায় বইয়ারে তুলা-নি,
আইছ্যা গাবুর লক্কুন কি গরন্ কি জানি।
ই-চ-র মাদাত ধান তলই,
জলা-জলি গাইততন্ গাবুরীলই।
মিল­া ধানতলই কুরায় খায়,
কি জানি পরান বিরে আইছ্যা কন্না পায়।
পশ্চিমে ডুবেল­ই পুব বেল,
চুবে-চাবে গাবুজ্যা গাবুরীরে কই গেল।
জুন পইজ্যা ভূই আদে,
পরান দ ন জুড়ায় তুই বাদে।
কদান কইনে লাঙ্যা দা গিয়ে গই,
ঘর উবরে উইচ্ছে গই।
ঝুবুক গাইছত্ পাইছ্ বাহ্,
বাঁশি বা-ধল­ই লাঙ্যা দা।
বাঁশী র শুনি মন কানে,
ইন্দি লাঙ্যাবী চন রানে।
চন তাবা চিদলে,
লাঙ্যাবী মন দি ন পারের গমে দোলে।
চনান উদুরাই পরেল­ই পেলাত্তুন,
ঔল গুরি ভাত পেলা বাদ দি-লই নুন।
জুরি পজ্যেই বু-য় খাদিয়ান ,
মাদিত্ পজ্যেই কাদিয়ান।
ধারা বা-ই-নে পরের ঘাম,
লাঙ্যাবীত্তুন আদত ন উদের কন কাম।। (বি.এন তঞ্চঙ্গ্যা,আদামর ফুল। পহ্র জাঙাল, ৫ম সংখ্যা)

প্রবাদ/ধাঁধা/গল্প/ছড়াঃ


ছোট বেলায় মা-বাবা থেকে অনেক গল্প, প্রবাদ ও ধাঁধা শুনেছি। আবদার করতাম সময় সুযোগ পেলে। বিশেষ করে যখন অবসরে থাকতাম সবাই। আর সঙ্গী-সাথী ও ভাই-বোন মিললেতো কোন কথায় নেই। প্রবাদ ও ধাঁধা ধরাধরি করতাম কে কতটা বলতে পারে। মাঝে মধ্যেতো এই নিয়ে ঝগড়া-ঝাটি, রাগারাগি হতো তবে সব কিছু সাময়িক পরে আবার ঠিক হতো। এভাবে অতিবাহিত ছোট বেলার প্রত্যেকটি দিন। মাঝে মধ্যে ভয় পেয়ে যেটাম মা-বাবারা যখন রাক্ষস বা ভূতের গল্প বলতেন। তবে রাজপুত্র যখন রাক্ষসদের মেরে রাজকন্যাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতেন রাক্ষসপুরী থেকে তখন আবার ভয় না পেয়ে খুশী বা মজাই পেতাম বেশী।

তঞ্চঙ্গ্যাদের গল্প, প্রবাদ ও ধাঁধার মধ্যে প্রকৃতির সাথে মানবিক ভারসাম্যতা বিদ্যমান। এখানে প্রতিটি বাক্য এবং চিন্তার সাথে প্রকৃতি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত সাথে আরো আশেপাশের প্রাণীকুল। তাদের নিত্য দিনের জ্ঞান,স্বভাব,অভ্যাস এবং আচরণগত নানা দিক। তন্চংগ্যারা প্রকৃতির সন্তান বলে তাই তাদের চিন্তার সাথে প্রকৃতি স্বাভাবিকভাবে এসেছে। তারা প্রকৃতির মতো কোমল-নরম,বিনয়ী,নম্রভাষী এবং লাজুক। প্রকৃতির মতো তাদের হাত পাথার(ভিক্ষা)কোন অভ্যাস নেই। কাউকে সহজে বড় কথাও বলতে পারে না। কথাবার্তা সবসময় সংযত। তন্চংগ্যাদের সবচেয়ে বড় গুন হচ্ছে চিন্তার সাথে তাদের আচরণগত ভারসাম্যতা । তাই তাদের প্রত্যেকটি সাহিত্যবার্তা বা সৃষ্টিবার্তার মধ্যে এই আচরণ ও অভ্যাসগত চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। নিম্মে সে রকম কিছু প্রবাদ,ধাঁধা ও গল্প তুলে ধরা হলো-

         (ক) কিট্স/ দা-অ কদা/প্রবাদঃ পেলায় পেলায় বাজ্জাবাড়ি খান, মুয়ত জয় মুয়ত খয়, পেদৎ বোক মুয়ত লাইত, এক্কয়া শিলৎ এক্কয়া কা(আ)ড়া, নরম পালে উ-ম কুরাও পুদান, মরা বাই-স সমারে জেদা বাই-স পুরি জান, আক্কল বাধি অনা, ইচা শুউনি অনা, ইহিম কামত্ ফল পানা,উসুনা কুড়ায় ডাক কারা না, কুড়া লাইত্, চি-ল দরে কুড়া ছ ন পুছানা, সিনডালে-অ লো ন নিড়ানা, মুঅ গুনে ব্যাঙ মরা, ঠেঙ(অ) কোইত্ ঊরি দেনা, দ্বি-জন ছেড়ে ছুমানা,পাইত্তে পাইত্তে রাইত্তে পাইত্, গুউত্তুন মুত্ গম্ অনা, রাঙা কালা মু অনা, ভুত্তোয়্যা কুউরে রোঙ কারা-না, আইদে আইদে ধদাডোদি টিক্ষ্যা কা(অ)রা গুরি, দা-শি দিলে নাচি খায় সবা-ইত্ ন পালে মা-ই খাই, ইসা-ব(হিসাব)গোরু(গরু) বায়ে(এ) খাই, খাঙ ন খাঙ ন খাঙ বালা যাঙ ন যাঙ ন যাঙ বালা, মুয়ত যউক পেদৎ ন যউক,বায়ু ফিরানা, নিমায়া নিতু,চিয়ন পআ কদা কুরা গু,সর্গ গু ন চিনা না,টাউ সুমা,ছাঅ-ল কানত্ মন্ত্র বরায় দেনা,আইছ কানত্ কুউরে বোউ না,সাপ্য়া উলে পুদাই দ ব্যাঙয়্যা উলে লাফাই দ,আগে গেলে বা-য় খায় পিছে তালে সোনা পাই । (ড. মনিরুজ্জামান,প্রবাদ ও তন্চংগ্যা প্রবাদের সাংস্কৃতিক অভিমুখ-পহ্র জাঙাল, ৫ম সংখ্যা এবং লেখক কর্তৃক সংগৃহীত )

Leave a Comment